ব্রিটিশদের অত্যাচারের ফলে মুসলমানরা যে ক্ষয়-ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছিল

0


সুদীর্ঘ সাত শত বছর রাষ্ট্র পরিচালনার পর মুসলিম নেতৃবৃন্দ যখন পারস্পরিক আত্মকলহ এবং বিলাসিতায় লিপ্ত হয়ে যথাযথ দায়িত্ব পালনে চরম অবহেলা প্রদর্শন করে তখন সুযােগ সন্ধানী সাম্রাজ্যবাদী ইংরেজ বেনিয়ারা বিভিন্নমুখী ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয় এবং মুসলমানদের হাত থেকে ক্ষমতা ছিনিয়ে নেয়। যে কারণে মুসলমানদেরকেই তারা তাদের প্রধান প্রতিপক্ষ মনে করত। তাই মুসলমানদের ক্ষতি ও ধ্বংস সাধনের যাবতীয় প্রয়াস তারা গ্রহণ করেছিল। মুসলমানদের ক্ষতি সাধনের এমন কোন হীন পন্থা ছিল না। যা তারা অবলম্বন করেনি। তারা ক্ষমতার মসনদকে নিষ্কন্টক করার স্বার্থে বিভিন্ন দিক থেকে মুসলমানদের উপর আগ্রাসন চালায় এবং তাদের বিরুদ্ধে নানা ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। ফলে এ উপমহাদেশের মুসলমানগণ অবর্ণনীয় এবং অপূরণীয় ক্ষতির সম্মুখীন হয়।











ইংরেজ কর্তৃক মুসলমানদের উপর আগ্রাসন এবং নির্যাতনের দিকগুলি ছিল নিমরূপঃ


রাজনৈতিক আগ্রাসন ও নিপীড়ন।
অর্থনৈতিক আগ্রাসন।
ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক আগ্রাসন।
পারস্পরিক কলহ সৃষ্টি এবং হক পন্থীদের অবদমিত করার বিভিন্ন কৌশল।


১. রাজনৈতিক আগ্রাসন ও নিপীড়ন:

রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ইংরেজরা মুসলমানদেরকেই তাদের একমাত্র প্রতিদ্বন্দ্বী এবং স্থায়ী শত্রু মনে করত। কারণ তাদের হাতেই ক্ষমতা হারানাের আশঙ্কা ছিল তাদের সর্বাধিক। অন্যদিকে মুসলিম সমাজের নেতৃত্ব দানকারী উলামা-ইকিরামের সংগ্রামী তৎপরতার কথাও ইংরেজরা আঁচ করতে পেরেছিল। ফলে উলামা-ই-কিরামই তাদের কোপানলে নিপতিত হয়েছিল সবচেয়ে বেশি। মুসলমানদের কোন রাজনৈতিক তৎপরতা যাতে দানা বাঁধতে না পারে এ ব্যাপারে তারা খুবই সজাগ ছিল। আলেম উলামাদেরকে বিশেষ করে নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদেরকে বিভিন্ন অজুহাতে হত্যা, দেশান্তর, জেলে প্রেরণ, তাদের সহায় সম্পদ বাজেয়াপ্তকরণ এবং বিভিন্নভাবে তাদেরকে হয়রানি করণে তারা ছিল সদা তৎপর। স্বাধীনতা যুদ্ধের ১৪ বছর পূর্বে ভারতের গভর্ণর জেনারেল বলেছিলেন, ‘মূলতঃ মুসলমানরাই যে আমাদের একমাত্র শত্রু এ বাস্তবতাকে উপেক্ষা করা যায় না।' তাই ইংরেজরা ক্ষমতারােহণের পর থেকেই সাধারণ মুসলমান এবং আলেম সমাজের উপর চালাতে থাকে অকথ্য নির্যাতন। এক্ষেত্রে ইংরেজদের অত্যাচারকে আমরা দু'ভাগে বিভক্ত করতে পারি।
ক: আলেম সমাজের উপর নির্যাতন:

ইংরেজদের নিকট এ কথা দিবালােকের ন্যায় স্পষ্ট ছিল যে, মূলতঃ আলেম সমাজই মুসলমানদের শক্তি ও প্রেরণার মূল উৎস এবং ইংরেজ বিরােধী চেতনা ছড়ানাের ক্ষেত্রে তারাই অগ্রণী ভূমিকা পালন করছেন। ফলে তারা আলেমদের প্রতি অত্যন্ত ক্ষেপা ছিল, বিশেষ করে ১৮০৩ সালে ইংরেজ কর্তৃক দিল্লী দখল হওয়ার পর, শাহ আব্দুল আযীয রাহ. ভারতকে দারুল হারব (শত্রু কবলিত দেশ) বলে ঘােষণা দিলে সারা দেশে যে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছিল তাতে তারা বিচলিত হয়ে পড়ে। এরপর থেকেই তারা আলেম সমাজকে অবদমিত করার জন্য অত্যাচার ও ষড়যন্ত্রের আশ্রয় নেয় এবং উলামায়ে কেরামকে জব্দ করার ব্যাপারে কোন অপকৌশল অবলম্বন করতে বাদ রাখেনি। দেশীয় মীর জাফরদের যােগসাজশে আলেম সমাজের আন্দোলনকে বিভিন্ন সময় চরমভাবে ব্যাহত করেছে। তারা মাওলানা শাহ আব্দুল আযীয রহ.-এর গায়ে টিকটিকির প্রলেপ লাগিয়ে দেয়। ফলে তিনি কুষ্ঠ রােগে আক্রান্ত হয়ে পড়েন এবং তার চার ভাইকে দেশান্তর করা হয়। ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিপ্লবের পর আলেম ও উলামাদের উপর ইংরেজদের নির্যাতন সীমা ছাড়িয়ে যায়, কেননা তারা আলেমদেরকেই এ আন্দোলনের জন্য দায়ী মনে করত। যে কারণে আলেম উলামারাই তাদের ক্রোধানলে বেশি নিপতিত হয়।

স্বাধীনতা সংগ্রামের অগ্রপথিক, হাজী ইমদাদুল্লাহ রাহ. এবং তার একান্ত শিষ্য মাওলানা কাসেম নানুতুবী রাহ, এবং মাওলানা রশীদ আহমদ গাংগুহী রাহ. এর বিরুদ্ধে গ্রেফতারী পরােয়ানা জারী করা হয় এবং তাদের ধরিয়ে দেওয়ার জন্য পুরস্কার ঘােষণা করা হয়। ফলে হাজী সাহেব কিছুদিন আত্মগােপন করে থাকেন। অতঃপর হিজরত করে মক্কা শরীফে চলে যান। মাওলানা নানুতুবী রাহ. দেশে আত্মগােপন করে থাকাকেই উত্তম মনে করেন। মাওলানা গাংগুহী রাহ. কে রামপুর থেকে বন্দী করে তিন দিন সাহারানপুরের জেলের এক অন্ধকার কুঠুরিতে রাখা হয়। তারপর তাঁকে জেল হাজতে প্রেরণ করা হয়। অতঃপর খােলা তরবারীর নিচে পায়ে হাঁটিয়ে তাকে মুজাফফর নগর নেওয়া হয়। সেখানে ৬ মাস বন্দী জীবন যাপন করেন। মামলায় তার বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট কোন অভিযােগ প্রমাণিত না হওয়ায় শেষ পর্যন্ত তিনি ফাসির হাত থেকে বেঁচে যান। যদিও হত্যা করাই ছিল ইংরেজদের আন্তরিক আকাঙ্খ।


১৮৫৭ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধে দু'লাখ মুসলমান শাহাদত বরণ করেছিল। তাদের মাঝে উলামা-ই-কিরামের সংখ্যা ছিল ৫১,৫০০। ইংরেজরা | আলিমদের উপর এতই ক্ষেপা ছিল যে, তারা যেখানেই কোন দাড়িওয়ালা, টুপি ও লম্বা জামাওয়ালা লােক দেখতে পেত, তার উপরই পাগলা কুকুরের মত ঝাপিয়ে পড়ত এবং তাকে ফাঁসিতে ঝুলাত।

এডওয়ার্ড টমাস বলেন: শুধু দিল্লিতেই ৫০০ আলিমকে ফাঁসি দেওয়া হয়েছিল। অনুরূপভাবে শায়খুল হিন্দ রাহ, এর রেশমী রুমাল আন্দোলন এবং বৃটিশ বিরােধী গােপন কুটনৈতিক, সামরিক এবং আন্তর্জাতিক তৎপরতা, তুর্কী প্রতিরক্ষা মন্ত্রী আনােয়ার পাশার সাথে তুকী -ভারত গােপন চুক্তি এবং খিলাফত আন্দোলন ও অসহযোেগ আন্দোলনে ইংরেজরা ছিল আতংকিত। তাই ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে হযরত শায়খুল হিন্দু এবং তাঁর চার সাথী, হােসাইন আহমদ মাদানী, মাওলানা ওযায়ের গুল, মাওলানা হাকিম সুনরাত হুসাইন, মৌলভী ওয়াহীদ আহমদকে সাড়ে তিন বছর মাল্টায় বন্দী করে রাখা হয়। এছাড়াও বহু আলেমকে তারা মাল্টায়, আন্দামানে, সাইপ্রাসে নির্বাসন দেয়। সেই নির্বাসিত জীবনে তাদের উপর যে অকথ্য নির্যাতন চালানাে হয় সে এক হৃদয় বিদারক করুণ কাহিনি, সে এক দীর্ঘ ইতিহাস। এভাবে আলেম সমাজকে রাজনৈতিক অঙ্গন থেকে সমূলে উৎখাত করার জন্য অত্যাচার ও নির্যাতনের বিভিন্ন কৌশল তারা অবলম্বন করে।
খ. সাধারণ মুসলমানদের উপর নির্যাতন:

আগেই বলা হয়েছে ইংরেজরা একমাত্র মুসলমানদেরকেই তাদের মূল শত্রু মনে করত। ফলে বিভিন্ন সময় তারা মুসলমানদের উপর বিভিন্ন কৌশলে নির্যাতন চালাত। বিশেষ করে ১৮৫৭ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধ ব্যর্থ হওয়ার পর ভারতবর্ষের মানুষের উপর অত্যাচার ও নির্যাতনের যে বিভীষিকা নেমে আসে, মুসলমানগণই ছিল সে জুলুম ও অত্যাচারের মূল শিকার। কারণ, স্বাধীনতা আন্দোলন মূলতঃ মুসলমানরাই করেছিল। মুলমানদের প্রতি তাদের অত্যাচার এতই নির্মম ছিল যে নিষ্পাপ শিশুরাও তাদের হাত থেকে রক্ষা পেতনা।

১৮৫৭ সালের ১৮ই নভেম্বরে দিল্লীর জামে মসজিদের আঙ্গিনায় এক দিনেই তারা ২৭ হাজার মুসলমানকে হত্যা করে। পাষণ্ড ইংরেজরা মুসলমানদের যখন হত্যা করত, তখন শুকরের চামড়ার মধ্যে পুরে সেলাই করে দিত এবং হত্যার পূর্বে শুকরের চর্বি গায়ে মাখিয়ে আগুন | জ্বালিয়ে দিত। লেফটেন্যান্ট মাণ্ডাজী লিখেছেন- একজন মুসলিম সিপাহীর মুখমণ্ডল সংগীনের আঘাতে ক্ষত বিক্ষত করা হয়, অতঃপর তাকে অল্প আগুনে ভুনা করা হয়। জ্বলন্ত মানুষের দুর্গন্ধে আমার মাথা ফেটে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল।

খাজা হাসান নিজামী লিখেছেন: `হাজার হাজার মুসলিম নারী ইংজেদের পৈশাচিক নির্যাতনের ভয়ে নিজেদের কূপে নিক্ষেপ করে আত্মহত্যা করেছে। অনেক পুরুষতত নিজের স্ত্রীকে হত্যা করে নিজেও আত্মহত্যা করেছে।' এসব ঘটনা তখন ঘটেছিল, যখন ইংরেজরা নিজেদেরকে সভ্য জাতি বলে আস্ফালন করত। লন্ডন টাইমস এর সংবাদদাতা মিঃ রাসেল ইংরেজদের অত্যাচার ও নির্যাতনের আরাে অসংখ্য ঘটনা উল্লেখ করেছেন। মূলতঃ তখন দিল্লীর অলিগলি হত্যাকাণ্ডের লীলাক্ষেত্রে পরিণত হয়েছিল, আর ঘর-বাড়ী রূপান্তরিত হয়েছিল জেলখানায়। প্রতিদিন হুগলী নদীর স্রোতে হাজার হাজার মুসলমানের লাশ ভেসে যেত। আর নরপিশাচ ইংরেজরা মনােরম উদ্যানে বসে মুসলমানের লাশ দেখে আনন্দ উপভােগ করত।
২. অর্থনৈতিক আগ্রাসন:

যেহেতু বৃটিশ সরকার একমাত্র মুসলমানদেরকেই তাদের প্রতিপক্ষ বলে ধরে নিয়েছিল এবং স্বাধীনতার ইন্ধন তারাই যুগাচ্ছে বলে মনে করত, এ কারণে বৃটিশ চিন্তাবিদরা এ সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছিল যে, ভারতে তাদের সাম্রাজ্য চিরস্থায়ী করতে হলে স্বাধীনতাকামী মুসলমানদেরকে আর্থিক দিক থেকে পঙ্গু করে রাখতে হবে। সুতরাং তারা মুসলমানদেরকে কাঙ্গালে পরিণত করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। একদিকে তারা সাধারণ মানুষ থেকে কঠোর শ্রম আদায় করে বিনিময়ে নামে মাত্র পারিশ্রমিক দিত। অন্যদিকে তাদের ঘাড়ে করের বােঝা চাপিয়ে দিয়ে লুটপাট করার পথ প্রশস্ত করেছিল । লুটপাট ও দস্যুবৃত্তি ছিল তাদের নেশা। তাই এ জন্য তারা নতুন নতুন কৌশল অবলম্বন করত। এ ক্ষেত্রে তারা যে জঘন্যতম কৌশল অবলম্বন করেছিল তা ছিল দেশীয় রাজ্যে নতুন নতুন নবাব নিয়ােগ করা। অভিলাষী নতুন নবাবরা ইংরেজদের মনঃতুষ্টির জন্য তার ধন ভাণ্ডার উন্মুক্ত করে। দিত, যখন ইংরেজরা বুঝতে পারে যে, তাদের ধনভাণ্ডার তারা সম্পূর্ণরূপে গ্রাস করে ফেলতে পেরেছে। তখন তাদেরকে পদচ্যুত করে নতুন নবাব নিয়ােগ করত। এভাবে তারা নবাবদের নিকট থেকে এত পরিমাণে অর্থ আদায় করত যে, সেই অর্থের চাপ গিয়ে পড়ত সাধারণ মানুষের উপর। নবাবরা সেই ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার জন্য সাধারণ মানুষের উপর অধিক হারে করের বােঝা চাপিয়ে দিত। এভাবে দেশ সম্পূর্ণ রূপ দেউলিয়া হয়ে গিয়েছিল।


পলাশীর যুদ্ধের পর মীর জাফরকে নবাব বানিয়ে তার নিকট থেকে ১ কোটি ২৩ লাখ ৮ হাজার ৫শত ৭৫ পাউন্ড গ্রহণ করে। অতঃপর তাকে ক্ষমতাচ্যুত করে মীর কাশিমকে নিয়ােগ করে। তার নিকট থেকে ২ লাখ ২ শত ৬৯ পাউন্ড আদায় করে। এভাবে মাত্র ৯ বছরে শুধুমাত্র বাংলার নবাবদের নিকট হতে ২ কোটি ৭১ লাখ ৬৯ হাজার ৬শত ৬৫ পাউন্ড লুট করে। তাছাড়া অন্যভাবে যে সম্পদ তারা আহরণ করেছিল তার পরিমাণ ছিল ৩ কোটি ২৮ লাখ ৭০ হাজার ৮শত ৩৩ পাউন্ড। ১৭৭২ সালে হাউস অফ কমনস-এর এক অধিবেশনে তারা এ অর্থ প্রাপ্তির স্বীকৃতি প্রদান করে। সুতরাং দুই শত বৎসরে তারা সারা ভারতবর্ষ থেকে কি পরিমাণ সম্পদ লুট করেছিল তা অনুমান করা যায়।

ইংরেজদের অর্থনৈতিক আগ্রাসনের ফলে মুসলমানদের যে অসহায় অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল সে সম্পর্কে স্যার সৈয়দ আহমদ বলেন: “দৈনিক দেড় আনা অথবা আধা সের শস্যের বিনিময়ে একজন ভারতীয় স্বেচ্ছায় স্বীয় গর্দান কর্তন করাতে প্রস্তুত ছিল।” তাছাড়া ব্যবসার ক্ষেত্রে তারা শােষণের যে অভিনব পন্থা অবলম্বন করেছিল, সে ইতিহাস তাে সকলেরই জানা। ক্রমান্বয়ে দেশীয় শিল্পসমূহকে পঙ্গু করে দেওয়া হয়। সে স্থলে তাদের দেশের পণ্যসমূহ এদেশে বাজারজাত করা হয়। এদেশে থেকে শিল্পের কাঁচামাল তারা। স্বল্প মূল্যে ইংল্যান্ডে নিয়ে যেত এবং তার দ্বারা উৎপন্ন দ্রব্য এদেশের বাজারে চড়া মূল্যে বিক্রি করা হত। কাঁচামাল উৎপাদনের জন্য কৃষকদেরকে নির্যাতনের মাধ্যমে বাধ্য করা হত, অথচ কৃষককে তার ন্যায্যমূল্য দেওয়া হত না। ফলে কৃষিভিত্তিক এদেশের অর্থনীতি চরমভাবে ভেঙ্গে পড়ে। এ ছাড়া সুদ ভিত্তিক দাদন ব্যবসার মাধ্যমে, কামার, কুমার, তাঁতী, জেলেসহ সকল শ্রেণীর মানুষকে তারা অর্থনৈতিক দিক থেকে দেউলিয়া করে ছেড়েছিল। মুসলমানদেরকে জমিদারী থেকে উচেছদ করে তাদেরকে নিঃস্ব করা হয়েছিল। উচ্চ পদস্থ সরকারী পদগুলাে থেকে মুসলমান কর্মকর্তাদেরকে অপসারিত করা হত এবং নতুন লােক নিয়ােগের ক্ষেত্রে এমন সব নতুন নতুন শর্তারােপ করা হত যাতে মুসলমানদের সরকারী চাকুরীতে নিয়ােগের পথ রুদ্ধ হয়ে যায়। এভাবে সরকারী চাকুরীর সুযােগ সুবিধা থেকে মুসলমানদেরকে বঞ্চিত করে তাদেরকে বেকারত্ব ও অর্থনৈতিক দেউলিয়াত্বের চরম পর্যায়ে ঠেলে দেওয়া হয়।


ডব্লিউ, এস ক্লিন্ট বলেন: “আমরা যদি লুটপাটের এ ধারাকে অব্যাহত রাখি তা হলে এমন এক সময় আসবে যখন ভারতীয়রা বাধ্য হয়ে একে অপরকে ভক্ষণ করবে”। স্যার জনসুর বলেন: “ইংরেজদের নিষ্পেষণ নীতি দেশ ও দেশবাসীকে এতই কাঙ্গালে পরিণত করেছে, যার নজির খুঁজে পাওয়া দুষ্কর।'




৩. ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক আগ্রাসন:

রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক আগ্রাসনের সাথে সাথে ইংরেজরা মুসলিম জাতিসত্তাকে সমূলে বিনষ্ট করার ষড়যন্ত্রে মেতে উঠে এবং এ উদ্দেশ্যে তারা মুসলমানদের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে আগ্রাসন চালাতে থাকে। তারা এমন সব অপকৌশল অবলম্বন করে ছিল যা দেখে স্বয়ং ইবলিশ পর্যন্ত বিস্ময়ে হতবাক হতে বাধ্য। পর্যালােচনার সুবিধার জন্য এ ক্ষেত্রে তাদের আগ্রাসনসমূহকে চারটি ভাগে ভাগ করে আলােচনা করা যায়। যথাঃ
ধর্মীয় শিক্ষার মূলােৎপাটন।
ধর্মান্তরিত করার অপচেষ্টা।
মসজিদকে গির্জায় রূপান্তরিত করণের চেষ্টা।
পারস্পরিক আত্মকলহ সৃষ্টি এবং হক পন্থীদের অবদমিত করার পায়তারা।


ক. ধর্মীয় শিক্ষার মূলােৎপাটন:

মূলতঃ শিক্ষাই জাতি মেরুদণ্ড। যে জাতি তাদের আদর্শ শিক্ষা হতে বঞ্চিত, তারা জাতি হিসাবে মৃত। সেকালে ভারত বর্ষের মুসলিম জাতি তাদের ধর্ম ভিত্তিক আদর্শ শিক্ষা বিস্তারের মাধ্যমে উন্নতির চরম শীর্ষে আরােহণ করতে সক্ষম হয়েছিল। তৎকালীন মুসলিম সরকারসমূহের পৃষ্ঠপােষকতায় হাজার হাজার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছিল গ্রামে-গঞ্জে, শহরে-বন্দরে।
ইংরেজরা ভালভাবেই অনুধাবন করতে পেরেছিল যে, মুসলমানরা সহজে নতী স্বীকার করার মত নয়। তাই এ দেশে তাদের ক্ষমতার মসনদকে সুদৃঢ় করতে হলে মুসলিম জাতির জাতিসত্বাবােধ ও আদর্শিক চেতনাকে হত্যা করা ছাড়া কোন বিকল্প নেই। তারা ভালো ভাবেই অনুধাবন করতে পেরেছিল যে, মুসলমানদের নিজস্ব শিক্ষা ও সংস্কৃতিই তাদের চেতনার উৎস বিন্দু। সুতরাং তার ধ্বংস সাধনকেই তারা তাদের প্রধান টার্গেট হিসাবে নির্ধারণ করেছিল । তদানীন্তন কালে সরকারী জায়গীরের আয় ও রাষ্ট্রীয় অনুদানের উপর ভিত্তি করেই পরিচালিত হত মুসলমানদের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলাে। ইংরেজরা ক্ষমতা লাভের পর রাষ্ট্রীয় অনুদানগুলাে বন্ধ করে দেয় এবং ভূমি সংস্কারের নামে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে প্রদত্ত সকল জায়গীরকে বাতিল করে দেয়। অর্থাভাবে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলাে মুখ থুবড়ে পড়ে। জন-অনুদানের উপর ভিত্তি করে যে গুটি কতক প্রতিষ্ঠান তখনও দাঁড়িয়ে ছিল, সেগুলােকেও নানাভাবে হয়রানি করা হয়। ফলে এ দেশে ধর্মীয় শিক্ষার ক্ষেত্রে এক বিরাট শূন্যতা বিরাজ করতে থাকে। যেখানে এ দেশের প্রতি ঘরে ঘরেই কেউ না কেউ একজন আলেম ছিল- যারা চেতনার আলাে বিলাতাে, সেখানে গ্রামকে গ্রাম খুঁজেও জানাযার নামায পড়াবার জন্য একজন আলেম পাওয়া যেতনা।


মুসলিম শিক্ষার এই করুণ পরিস্থিতি সৃষ্টি করে তদস্থলে তারা ইংরেজি শিক্ষা ব্যবস্থার প্রবর্তন ঘটায়। সে প্রতিষ্ঠানগুলােতে মুসলিম সন্তানদের চেতনাকে প্রভাবিত করা হত ভিন্ন খাতে এবং একই সঙ্গে তাদেরকে এমন এক জীবনবােধ ও চেতনার সাথে পরিচিত করে তােলা হত, যা ছিল ইসলামী সভ্যতা ও সংস্কৃতির পরিপন্থী। মুসলমানদের লেবাস পােষাককে ব্যঙ্গ করার জন্য খানসামা ও দারােয়ানের পােষাক নির্ধারণ করা হয়েছিল পায়জামা, পাঞ্জাবী ও পাগড়ী। ইসলামী জীবনবােধ ও চর্চাকে সেকেলে বলে ব্যঙ্গ করা হত। এভাবে ক্রমান্বয়ে তারা ইসলামী জীবন ধারার স্থলে পাশ্চাত্য জীবন ধারার সাথে পরিচিত করে তােলতে চেয়েছিল মুসলমানদেরকে। দীর্ঘদিন শিক্ষার চর্চা না থাকার ফলে নতুন প্রজন্মের অশিক্ষিত মুসলিম সমাজের অনেকেই নিজেদের জীবনধারাকে তাদের সভ্যতা ও সংস্কৃতির আলােকে গড়ে তুলতে প্রয়াসী হয়েছিল। ক্রমান্বয়ে ইসলামী চেতনায় উজ্জীবিত এ দেশের মুসলমানরা তাদের জীবন ধারা ভিন্ন আরেক খাতে প্রবাহিত করতে শুরু করেছে দেখেই আলেম উলামা যারা ছিলেন, তারা ইংরেজদের প্রতিষ্ঠিত স্কুলে লেখাপড়া করা হারাম বলে ফতওয়া দিয়েছিলেন। ইংরেজ আগ্রাসনের পূর্বে শুধু রাজধানী দিল্লিতেই ১০০০ মাদ্রাসা ছিল। প্রফেসর মার্ক মিলস বলেন: “বৃটিশ শাসনের পূর্বে শুধু বাংলাদেশেই আশি হাজার মাদ্রাসা ছিল।


সিন্ধুর প্রসিদ্ধ ঠাট্রানগরী সম্বন্ধে ক্যাপ্টেন হেমিলটন বলেন: ‘ এ শহরে নানা প্রকার জ্ঞান-বিজ্ঞান এবং শিল্পকলার চার শত প্রতিষ্ঠান ছিল। ইংরেজরা বিভিন্ন ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে মুসলিম আমলের প্রতিষ্ঠিত কুরআন ও সুন্নাহ ভিত্তিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিকে নির্বিচারে ধ্বংস করে দেয় এবং সেস্থলে তাদের ধ্যানধারণা পুষ্ট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চালু করে। যাতে কেউ নামে মুসলমান হলেও চিন্তাচেতনায় ইংরেজ হতে বাধ্য হয়।’ এ সম্পর্কে ইংল্যান্ডের লর্ড ম্যাকলে পরিস্কার ভাষায় বলেছিলেন- “ভারতীয়দের জন্য আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার একমাত্র উদ্দেশ্য হল এমন এক যুব সম্প্রদায় সৃষ্টি করা, যারা রঙ ও বংশের দিক থেকে ভারতীয় হলেও মন ও মস্কিষ্কের দিক থেকে হবে সম্পূর্ণ বিলাতী (খ্রীষ্টান)”।
এক সময় মুসলমানদের চাপের মুখে তারা আলিয়া মাদ্রাসা নামে কলিকাতায় যে মাদ্রাসা গড়ে তুলেছিল তা ছিল নিছক প্রহসন। মজার কথা হল মুসলমানদের ধর্মীয় শিক্ষার জন্য তারা যে মাদ্রাসাটি প্রতিষ্ঠা করেছিল দীর্ঘকাল যাবত ২৬ জন খ্রীষ্টান তার অধ্যক্ষের দায়িত্বে নিয়ােজিত ছিল। সুতরাং এ ব্যবস্থায় মুসলমানদের ধর্মীয় শিক্ষার আনুকূল্য কতটা অর্জিত হয়েছিল তা সহজেই অনুমান করা যায়। ইংরেজদের প্রতিষ্ঠানে লেখাপড়া করলে আদর্শিক বিচ্যুতির শিকার হয়ে মুসলমান সন্তানেরা বিভ্রান্ত হবে, বিনষ্ট হবে তাদের ধর্মীয় অনুভূতি-এই আশঙ্কায় মুসলমানরা তাদের সন্তানদেরকে ইংরেজদের প্রতিষ্ঠিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠানাের ঘাের বিরােধী ছিলেন। ফলে মুসলমানগণ জাগতিক ও ধর্মীয় শিক্ষা উভয় ক্ষেত্রে এক অপুরণীয় ক্ষতির সম্মুখীন হয়।


খ. ধর্মান্তরিত করার অপচেষ্টা:
ঘাতক ইংরেজ সাম্রাজ্যবাদীরা শুধু ক্ষমতা কেড়ে নিয়েই ক্ষান্ত হয়নি। ক্রমশঃ তারা এদেশের মানুষকে খ্রীষ্টান বানানাের জন্য বিভিন্ন রকম অপকৌশল অবলম্বন করে। দারিদ্র এবং অসহায়ত্বের শিকার-এ জাতিকে চাকুরী এবং সুন্দরী যুবতীর প্রলােভন দেখিয়ে ধর্মান্তরিত করার চেষ্টা করা হত। বিশেষ করে ১৮৩৭ সালের দুর্ভিক্ষে যে সব শিশু এতিম হয়েছিল, লালন-পালনের নামে তাদেরকে খ্রীষ্টান বানানাে হয়েছিল। এদেশের মানুষকে ধর্মান্তরিত করার জন্য প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত পাদ্রীদেরকে এদেশে আমদানী করা হয়। যারা বিভিন্ন যুক্তির মাধ্যমে খ্রীষ্টান ধর্মের মহত্ব ও ইসলামের অসারতা জনসম্মুখে তুলে ধরত। ইংরেজ অফিসারগণ খ্রীষ্টান প্রাদীদেরকে কর্মচারীদের বাস ভবনে উপস্থিত হয়ে তাদেরকে খ্রীষ্টান ধর্মের প্রতি উৎসাহিত করার জন্য কড়া নির্দেশ দিত এবং কার্যত তাই হত।
ইংরেজদের বক্তব্য ছিল, আমাদের গভর্নমেন্টের ইচ্ছা, দেশে প্রচলিত সকল ধর্ম ও রীতি-নীতি বিলুপ্ত করে সকলকে খ্রীষ্টান ধর্মে দীক্ষিত করা। সুতরাং এ উদ্দেশ্যে তারা আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে ছিল।


গ. মসজিদকে গির্জায় রূপান্তরিত করণের চেষ্টা:
ইংরেজরা একদিকে যেমন বিভিন্ন ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে মুসলমানদেরকে খ্রীষ্টান বানানাের চেষ্টা চালিয়েছে, অন্যদিকে তাদের প্রিয় ইবাদত খানা মসজিদকে গির্জা বানানাের চেষ্টা করেছে। দিল্লীর জামে মসজিদকে গির্জায় রূপান্তরিত করার জন্য তারা চেষ্টার কোন ত্রুটি করেনি। জোরপূর্বক সর্বত্র তারা তাদের প্রচার কার্য চালাত এবং মুসলমানদের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হত। সে সময় বহু মসজিদকে তাদের পৃষ্ঠপােষকতায় মন্দির ও গির্জায় রূপান্তরিত করা হয়েছিল। বাবরী মসজিদকেও তারা সে সময় মন্দিরে পরিণত করেছিল।






সোর্স: ইন্টারনেট


Post a Comment

0Comments
Post a Comment (0)
To Top